তামাক দ্রব্যে ছবিসহ সতর্কবাণী: আইন বনাম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ঠোকাঠুকি

সিগারেটের প্যাকেটে ছবি সম্বলিত সতর্কবাণী যোগ করার সময় নিয়ে মতবিরোধ চলছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং অাইন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে।

ধূমপানের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরতে সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে সতর্কতামূলক ছবি (পিকটোরিয়াল হেলথ ওয়ার্নিং বা গ্রাফিক ওয়ার্নিং ) বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যুক্ত করেছে। বাংলাদেশেও ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০১৩ তে বলা হ‌‌‌য়েছে– তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেট, মোড়ক, কার্টন বা কৌটায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সরবরাহ করা রঙিন ছবি ও লেখা সমন্বিত স্বাস্থ্য সতর্কবাণী অবিকল ছাপতে হবে।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় গত বছরের নভেম্বর মাসে একটি খসড়াও প্রস্তুত করে। সেখানে ছবিসহ সতর্কবার্তা যুক্ত করার সময় ছয় মাস থেকে বাড়িয়ে নয় মাস করে বিধিমালার খসড়া চূড়ান্ত করে ভেটিংয়ের জন্য অাইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু আইন মন্ত্রণালয় সিগারেট কোম্পানিগুলোর পক্ষ নিয়ে সতর্কবাণীযুক্ত করার সময় নয় মাস থেকে বাড়িয়ে তা ১৮ মাস করার প্রস্তাব দিয়ে আবারো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে বিধিমালার খসড়াটি ফেরত পাঠায়।

সিগারেটের প্যাকেটে সতর্কবাণী যুক্ত করার সময় নির্ধারণে দুই মন্ত্রণালয়ের মধ্যে চলছে মতবিরোধ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিধিমালা কার্যকরের নয় মাস পর তামাকজাত পণ্যের প্যাকেটে সতর্কবাণী যুক্ত করার কথা বললেও আইন মন্ত্রণালয় তা বাড়িয়ে প্রস্তাব করেছে ১৮ মাস করার। এ অবস্থায় বিধিমালা চূড়ান্ত না হওয়ায় বিড়ি-সিগারেটের প্যাকেটে স্বাস্থ্য সতর্কতার সতর্কবাণী যুক্ত করতেও কালক্ষেপণ হবে।

গত এপ্রিলে পাস হওয়া সংশোধিত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের আলোকে একটি বিধিমালা তৈরির উদ্যোগ নেয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। গত বছরের নভেম্বর মাসে একটি খসড়াও প্রস্তুত করা হয়। ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০১৩‘ নামে বিধিমালার খসড়ায় বলা হয়েছে, তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেট, মোড়ক, কার্টন বা কৌটায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সরবরাহ করা রঙিন ছবি ও লেখা সমন্বিত স্বাস্থ্য সতর্কবাণী অবিকল ছাপতে হবে।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার টেকনিক্যাল অফিসার ড. মাহফুজুল হক এ বিষয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পিকটোরিয়াল ওয়ার্নিং এর বিষয়টি যুক্ত করে ২০১৩ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ অাইনের সংশোধনী হয়েছে। অাইনটি পাস হয়েছে কিন্তু এ সংক্রান্ত অন্যান্য সবকিছু লিপিবদ্ধ থাকবে বিধিমালাতে।‘

তিনি বলেন, ‘অামরা জানতে পেরেছি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে বিধিমালাটি অাইন মন্ত্রণালয়ে, সেখান থেকে সেটি অাবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অাসা-যাওয়া করছে। কিন্তু একটা কথা পরিষ্কার করতে চাই, এই বিধিমালা যতোদিন অাটকে থাকবে দিন কে দিন জনস্বাস্থ্য ততোই হুমকীর মুখে পড়বে।

তাই কোনোভাবেই বিধিমালা নিয়ে এই দীর্ঘসূত্রতা কাম্য নয়। অাশা করবো যত দ্রুত সম্ভব বিধিমালাটি পাস হয়ে অাসুক।‘

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রতিবছর তামাক ব্যবহারের ফলে বাংলাদেশের ১২ লাখ লোক ৮টি মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। আর এসব রোগীর মাত্র ২৫ শতাংশ চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। এ হিসেবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ১১ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। তামাক ব্যবহারের প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে প্রতিবছর বাংলাদেশে ৫৭ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করছে।

এখানেই শেষ নয়, পঙ্গুত্ববরণ করছে ৩ লাখ ৮২ হাজার লোক। ২০০৯ সালে প্রকাশিত গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠী ৪ কোটি ১৩ লাখ লোক তামাক সেবন করে, যা মোট জনসংখ্যার ৪৩ দশমিক ৩ শতাংশ। আর পুরুষদের মধ্যে তামাক সেবনের হার ৫৮ শতাংশ এবং নারীদের মধ্যে এ হার ২৮ দশমিক ৭।

এদিকে তামাক নিয়ন্ত্রণ ‌‌‌অাইন ২০১৩-এর প্রস্তাবিত খসড়াটি চূড়ান্ত করে ভেটিংয়ের জন্য অাইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে অনেক অাগেই। কিন্তু একবছরেরও বেশি সময় পেড়িয়ে গেলেও অাজও সেটি চূড়ান্ত হয়নি।

প্রস্তাবিত ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা’র খসড়া প্রণয়নকারী কমিটির সদস্য সচিব এবং জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সমন্বয়কারী আমিন উল আহসান এ বিষয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পিকটোরিয়াল ওয়ার্নিংয়ের বিষয়ে অামরা সময় দিয়েছি নয় মাস কিন্তু অাইন মন্ত্রণালয় সেটিকে ১৮ মাস করতে চায়। মূলত যখন ভেটিংয়ে যায় তারা বিভিন্ন ধারার ওপর কমেন্ট করতে পারে। কিন্তু এ ধরনের মতামত দেওয়ার এখতিয়ার তাদের নেই। অার অামরা তাদের বলেছি, এটা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় করেছে অান্তর্জাতিক মানদণ্ড (ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড) বজায় রেখে। এটা অামাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্য সচিব অনুমোদন করেছেন।‘

অামিন উল অাহসান অারও বলেন, “অাইন মন্ত্রণালয় থেকে যখন ১৮ মাসের প্রস্তাব দিয়ে অামাদের কাছে ফেরত পাঠানো হয় তখন তার সাথে সম্পূর্ণ অমত প্রকাশ করে অাবার সেটি ফেরত পাঠিয়েছি। কিন্তু তারা এখনো তাদের ভেটিং দিয়ে অামাদের কাছে পাঠায়নি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে অামরা একটি ‘তাগ‌‌‌াদা পত্র‘ও গত সপ্তাহে পাঠিয়েছি তাদের কাছে। বিষয়টি ব্যক্তিগতভাবেও তাদের বলা হয়েছে। কিন্তু অাইন মন্ত্রণালয় ‘হয়ে গেছে‘, ‘এ সপ্তাহেই দিচ্ছি-দেব‘ করে এখনো দিচ্ছে না। তারা বিলম্ব করছে।”

বিশ্বস্ত একটি সূত্র বাংলা ট্রিবিউনকে জানায়, বিধিমালাটি ভেটিংয়ে থাকা অবস্থায় গত ১২ মার্চ অাইনসচিবের সঙ্গে মিটিং করে বাংলাদেশ সিগারেট ম্যানেফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ বিড়ি শিল্প মালিক সমিতির নেতৃত্বাধীন একটি তামাক প্রতিনিধি দল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ভেটিং সম্পন্ন না করেই কয়েকটি কমেন্টসহ গত জুন মাসের শেষের দিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অাবার সেটি ফেরত অাসে। এই কমেন্টগুলোরই অন্যতম হলো– বিধিমালা কার্যকরের পর তামাকজাত পণ্যের প্যাকেটে সতর্কবাণী যুক্ত হবে ১৮ মাস পর। অথচ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এটি করেছিল নয় মাস।

এ বিষয়ে জানতে অাইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের সচিব শহিদুল হকের নম্বরে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

এদিকে, গত ২৩ জুলাই স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের সঙ্গে বিটিশি আমেরিকান টোব্যাকোর (বিএটি) চেয়ারম্যান গোলাম মাঈনুদ্দীন, এমডি শেহেজাদ মুনীম, হেড অব সিএসঅার কামরূল ইসলামসহ অন্যান্যরা সচিবালয়ে একটি বৈঠকে অংশ নেন। এক ঘণ্টার বেশি এ বৈঠকে তামাক নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা নিয়ে তাদের অালোচনা হয়। বিধিমালা পাশের প্রক্রিয়া থাকাকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তামাক কোম্পানির প্র‌‌‌তিনিধিদের এ বৈঠক তামাক বিরোধীদের মনে শঙ্কার জন্ম দিয়েছে। তারা মনে করছেন, বিধিমালা পাসের প্রক্রিয়াকে দীর্ঘায়িত করতে তামাক কোম্পানিগুলো স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে প্রভাবিত করেছে।

তামাক বিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞা মনে করে, বিধিমালা যতো দেরি করে পাস হবে ততোই দেরি হবে অাইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে। তাই জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় তামাক নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা অবিলম্বে পাশের তাগিদ দিয়েছেন তারা।

Source:বাংলা ট্রিবিউন, জাকিয়া আহমেদ,প্রকাশিত: আগস্ট ২৭, ২০১৪

About Tobacco Industry Watch

House 6 (3rd Floor, East Side), Main Road 3, Block A, Section 11, Mirpur, Dhaka-1216
Tel: +88-02-9005553, Fax : +88-02-8060751,
URL : www.tobaccoindustrywatchbd.org, Skype ID: progga.bd

Email: progga.bd@gmail.com, info@tobaccoindustrywatchbd.org