বাজেটে কর না বাড়াতে সরকারকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে

বাজেটে কর না বাড়াতে নানা অপকৌশল নিচ্ছে বিড়ি মালিকরা। কখনও শ্রমিকদের, কখনও এমপি-মন্ত্রীদের আবার কখনও বিভিন্ন সংস্থার আশ্রয় নিয়ে বিড়ি কোম্পানির মালিকরা বিভ্রান্ত করছে সরকারকে। আর এভাবেই নানা কূটকৌশলের কারণে বিড়ি থাকছে প্রকৃত করের আওতার বাইরেই। ফলে দামে সস্তা হওয়ায় এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্যান্সারসহ নানা ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বিড়ি ব্যবহারকারীরা। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিড়ি কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে তুলে ধরা হয়েছে তাদের দাবি। আগামী ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটকে সামনে রেখে অতীতের মতো অপতৎপরতা ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে। এ রকম নানা কৌশলের চিত্র উঠে এসেছে অনুসন্ধানে।
এ বিষয়ে অর্থ প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান জনকণ্ঠকে বলেন, বিড়ি কোম্পানিগুলোর কোন কৌশলই হয়ত এবার কাজে আসবে না। কেননা আগামী বাজেটে বিড়ির ওপর শুল্ক বাড়ানোর চিন্তা করা হচ্ছে। যাতে এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা কমে যায়। যদিও এখনও বাজেট দেরি আছে। ফলে বিষয়টি এখনও প্রাথমিক পর্যায়, চূড়ান্ত কিছুই হয়নি। কিন্তু তারপরও আমি বলব আমরা পজেটিভ। অর্থাৎ বিড়ির কর বাড়ানোর ক্ষেত্রে আমরা পজেটিভ বলেছি, কিন্তু বিড়ি কোম্পানিগুলোর পক্ষে পজেটিভ বলিনি।
এ বিষয়ে দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক মোস্তফা কে. মুজেরী জনকণ্ঠকে বলেন, যতদিন পর্যন্ত তামাক পণ্যের চাহিদা রয়েছে ততদিন উৎপাদন হবে এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু এটি যেহেতু নিকৃষ্ট পণ্য কাজেই এর চাহিদাকে নিরুৎসাহিত করতে অবশ্যই উচ্চ হারে করারোপ করা উচিত। আমরা জানি যেকোন পণ্যের মূল্য বাড়ল এর চাহিদা কমে। তাই তামাক পণ্যের ব্যবহার কমাতে অনেক পথের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে টাস্ক বাড়ানো। উচ্চহারে করের হার বাড়ানোর বিষয়ে সামাজিক যৌক্তিকতা রয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রতিবছর বাজেটের আগে কর না বাড়ানোর দাবি জানিয়ে নীতি-নির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বিভিন্ন কর্মসূচীর আয়োজন করা হয়। এসব কর্মসূচীতে বিড়ি শ্রমিকদের ফ্রন্ট গ্রুপ হিসেবে ব্যবহার করে বিড়ি কোম্পানিগুলো। সর্বশেষ চলতি অর্থবছরের (২০১৩-১৪) বাজেটে বিড়ির ওপর সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হলেও তামাক কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিক বিড়ি শ্রমিকদের বিক্ষোভের মুখে চূড়ান্ত বাজেটে তা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। আবার বিড়ির পক্ষে নীতি নির্ধারকদের অবস্থান মজবুত করতে বিড়ি মালিকরা বিভিন্ন চালাকির আশ্রয় নেয়। এক্ষেত্রে বলা যায় চলতি বছর বাজেট প্রণয়নের আগে হিউম্যান রিসোর্স এ্যান্ড হেলথ ফাউন্ডেশন নামে একটি সংগঠন কেবলমাত্র কমদামী সিগারেটের শুল্ক দ্বিগুণ করার দাবি জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সামনে মানববন্ধন এবং রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করে। রিসার্স এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কালেক্টিভ (আরডিসি) নামের অপর একটি সংস্থা বাজেট ঘোষণার আগে শ্রমিকদের বাঁচানোর অজুহাতে বিড়ির ওপর কর কমানোর জন্য মন্ত্রী, রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি জনস্বাস্থ্যবিদ ও শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সভা-সমাবেশ, সেমিনার ও টেলিভিশন টকশোর আয়োজন করে।
পাশাপাশি তারা বিড়ি শ্রমিকদের নিয়ে স্বল্পদৈঘ্য চলচ্চিত্রও তৈরি করে। ২০১২-১৩ এবং ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেট তৈরির প্রাক্কালে ক্যাম্পেন ফর ক্লিন এয়ার নামে একটি সংগঠন তাদের পরিচালিত জরিপের মাধ্যমে তামাক পণ্যের বহুল ব্যবহারের জন্য সিগারেটকে দায়ী করে এর ওপর অধিকহারে কর বাড়ানোর সুপারিশ করে। ২০১১ সালের বাজেট প্রণয়নের আগে জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে এমন কয়েকটি এনজিও সিগারেটের বিরুদ্ধে সমমনা গোষ্ঠী (সিগাট) নামের একটি ফোরাম গঠন করে। ওই ফোরামটি ওই বছর বাজেটের আগে শুধু সিগারেটের ওপর কর বাড়ানের জন্য বিভিন্ন প্রচারণা চালায়। এভাবে কেবল সিগারেটের ওপর কর বৃদ্ধির নামে বিড়ির ওপর কর ঠেকানোর উদ্দেশে বিড়ি মালিকদের বিভিন্ন অপকৌশল প্রতিবছরই চোখে পড়ে।
এ ছাড়া বিড়ি কোম্পানিগুলো যে কাজটি বিশেষভাবে করে থাকে তা হচ্ছে, প্রতিবছর বাজেট ঘোষণার আগে বিড়ির ওপর কর আরোপ না করতে সংসদ সদস্যদের মাধ্যমে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে সুপারিশপত্র (ডিও) পাঠায়। চলতি অর্থবছরের বাজেটের আগে প্রায় দুই শতাধিক সংসদ সদস্য বিড়ির ওপর কর না বাড়াতে এবং এর ওপর বিদ্যমান সমস্ত কর প্রত্যাহার করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং অর্থমন্ত্রণালয়ে ডিও পাঠায়। ২০০৯ সালে জাতীয় সংসদে বাজেট অধিবেশনে একজন সংসদ সদস্যের বিড়ির ওপর প্রস্তাবিত কর প্রত্যাহারের আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী বিড়ির ওপর আরোপিত বাড়তি কর প্রত্যাহারের সুপারিশ করেন। এর পর ওই অর্থবছরে বিড়ির ওপর প্রস্তাবিত বাড়তি কর প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। প্রায় প্রতিবছরই সংসদ সদস্যরা বিড়ি মালিকদের পক্ষে অবস্থান নেয়ায় বিড়ির ওপর পরবর্তী বছরগুলোতে কোন উল্লেখযোগ্য করারোপ করতে দেয়া যায়নি।
বিড়ি শিল্পে কর্মসংস্থানের মিথ্যা দোহাই দিয়ে এনবিআরের ওপর কর না বাড়ানোর চাপ দেন সংসদ সদস্যরা। তাঁরা দাবি করেন শিল্পে ২৫ লাখের বেশি কর্মী জড়িত। এর অধিকাংশই নারী ও শিশু। তবে এ বিষয়টিকে একেবারেই মিথ্যা তা প্রমাণিত হয়েছে পরবর্তীতে পরিচালিত এক জরিপে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারী সংস্থা ক্যাম্পেন ফর টোব্যাকো ফ্রিকিডসের (সিটিএফকে) সহায়তায় পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, দেশের ৩১টি জেলায় ১১৭টি বিড়ি কারখানা চালু আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৯টি কারখানা আছে রংপুরে এবং লালমনিরহাটে আছে ১৩টি। এসব কারখানায় প্রত্যক্ষভাবে কাজ করে ৬৫ হাজার শ্রমিক। তবে এর বাইরে প্রত্যেক প্রত্যক্ষ শ্রমিকের বিপরীতে তিন থেকে চারজন পরোক্ষ শ্রমিক কাজ করে। সে হিসেবে মোট বিড়ি শ্রমিকের সংখ্যা তিন লাখের বেশি নয়। অর্থাৎ দেশের মোট শ্রম শক্তির মাত্র শূন্য দশমিক এক ভাগ হচ্ছেন বিড়ি শ্রমিক।
এ বিষয়ে জাতীয় সংসদের সাবেক স্পীকার এবং বর্তমানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি প্রফেসর আলী আশরাফ এমপি জনকণ্ঠকে বলেন, অনেক এমপির এলাকায় বিড়ি ফ্যাক্টরি আছে। তাই তাদের ইন্টারেস্ট দেখতে গিয়ে ডিও লেটার পাঠায়। এটি ঠিক নয়।
আগামী ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটকে সামনে রেখে সম্প্রতি রাজস্ব বোর্ড আয়োজিত প্রাক বাজেট আলোচনায় অংশ নেয় বিড়ি কোম্পানির মালিকরা। তারা দাবি করে সরকার সিগারেট কোম্পানিকে নানা সুবিধা দিলেও বিড়ি কোম্পানিগুলোকে দিচ্ছে না। প্রতিবছর বিড়ির ওপর সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হলেও সিগারেটে কমানো হয়। বিড়ি শিল্পে সুবিধা না দিয়ে সরকার সিগারেটের প্রতি সহানুভূতি দেখাচ্ছে। যার কারণে বিড়ি শিল্প বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।
বিড়ির ওপর কর বিষয়ে দেশে সবচেয়ে বিড়ি সমৃদ্ধ এলাকা রংপুরের হারাগাছের মেনাজ বিড়ির মালিক জাহিদ হোসেনের আগে জনকণ্ঠকে বলেছিলেন, তাঁর কোম্পানিতে প্রায় ২ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। কম দাবি সিগারেটের ব্যাপক প্রসার হওয়ায় দিন দিন বিড়ির চাহিদা কমে যাচ্ছে। বিড়িতে কর বাড়ানোর বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য (কর নীতি) সৈয়দ আমিনুল করিম জনকণ্ঠকে বলেন, এবারের তামাক পণ্যের ওপর কর বাড়ানো হবে। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। যে যাই বলুক এ বছর পরিস্থিতি একটু অন্যরকম।
বিড়ি শ্রমিক মুক্তা (৯)। রংপুরের হারাগাছ সাহেবপাড়ায় বসবাস। বাবা ট্রাক হেলপার। পরিবারের মাসিক আয় ২৫০০-৩০০০ টাকা। এ আয়ে ৫ জনের সংসার চলে না। মুক্তা ও তার বড় বোনকে তাই মায়ের সঙ্গে বিড়ি তৈরির কাজ করতে হয়। মাত্র ৭ বছর বয়সই সে বিড়ির কাজ শুরু করে। সপ্তাহের বুধ ও শনিবারে সে মায়ের সঙ্গে বিড়ি কারখানায় যায়। সকাল ৮টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত কাজ করে। এ সময়ে সে ৫ হাজার বিড়ির মাথা মোড়ানোর কাজ করতে পারে যার মজুরি প্রতি হাজারে ৭ টাকা। মায়ের কাজের অংশ হিসেবে সে এ কাজ করে। মূলত তার মা সপ্তাহে ১৮,০০০ হাজার বিড়ি তৈরির অর্ডার পায়।
বুধবারে জমা দিতে হয় ৯ হাজার এবং বাকি ৯ হাজার জমা দিতে হয় শনিবার। মুক্তার বোন ও মা বাড়িতে বসে ৪ দিনে এই ১৮,০০০ বিড়ির ঠোস তৈরি করে। সপ্তাহের দুই দিনে (বুধ ও শনি) কারখানায় ঠোসগুলিতে তামাক ভরা, মাথা মোড়ানো এবং প্যাকেটজাত করার কাজ করে মুক্তা আর তার মা। এক সপ্তাহে এই ১৮ হাজার বিড়ির জন্য মুক্তার মা মজুরি হিসাবে কারখানা থেকে পায় মাত্র ৩৩০ টাকা যার মধ্যে মুক্তার আয় ৭০ টাকা। অর্থাৎ মজুরি থেকে তার মাসিক গড় আয় মাত্র ২৮০ টাকা। মুক্তা দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়লেও নিয়মিত স্কুলে যায় না। দিনে দিনে রোগা হয়ে পড়ছে সে। জ্বর, কাশি প্রভৃতি কারণে তাকে মাঝে মাঝেই স্কুল ও কারখানার কাজ কামাই করতে হয়। এ কাজ করতে কেমন লাগে, এ প্রশ্নের কোন উত্তর দেয়নি মুক্তা।
হারাগাছের বিশিষ্ট বিড়ি শ্রমিক নেতা আমিন উদ্দিন আহমেদ এর আগে বলেছিলেন, বিড়ি শিল্পে যাতে করারোপ না হয় সেজন্য প্রতিবছরই আন্দোলন হয়। শ্রমিকদের স্বার্থে আমরাও রাজপথে নামি। তবে শ্রমিকদের ভাগ্যেও তেমন উন্নতি হয়নি। বিড়ি মালিকরা ঠিকই লাভ করেন, তার অংশ শ্রমিকরা পায় না।
তবে কিছুটা সচেতনতা এসেছে বিড়ি শ্রমিকদের মাঝে। এর অংশ হিসেবে সম্প্রতি বিকল্প কর্মসংস্থানের দাবিতে বিক্ষুব্ধ বিড়ি শ্রমিকরা রংপুর একটি বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের আয়োজন করে। সমাবেশে তাঁরা বলেন, বিড়ি শ্রমিকরা চরম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করে। অন্য যেকোন কাজের তুলনায় মজুরিও কম। সপ্তাহে তিন চারদিনের বেশি কাজও থাকে না। বিড়ি শিল্পের কাজে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ঝুঁকিও অন্য কাজ থেকে অনেক বেশি। এসব বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বিড়ি শ্রমিকরা বিক্ষুব্ধ বিড়ি শ্রমিকের ব্যানারে বিকল্প কর্মসংস্থানের দাবিতে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে।

Source: Daily Janakantha

হামিদ-উজ-জামান মামুন,মঙ্গলবার, ৬ মে ২০১৪

About Tobacco Industry Watch

House 6 (3rd Floor, East Side), Main Road 3, Block A, Section 11, Mirpur, Dhaka-1216
Tel: +88-02-9005553, Fax : +88-02-8060751,
URL : www.tobaccoindustrywatchbd.org, Skype ID: progga.bd

Email: progga.bd@gmail.com, info@tobaccoindustrywatchbd.org