রাজস্ব হারানোর অজুহাতে বাড়ে না তামাক পণ্যে কর

রাজস্ব হারানোর মিথ্যা অজুহাতে দেশে দীর্ঘদিন ধরে তামাকজনিত স্বাস্থ্য ক্ষতি উপেক্ষিত হচ্ছে। রাজস্ব হারানো ও রাজস্ব ফাঁকির ভয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) তামাকের কর কাঠামোয় পরিবর্তন করে না। অথচ জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর তামাকের ক্ষতিকর প্রভাবের বিষয়টি বিবেচনা করে তামাকবিরোধী সংগঠনগুলো তামাক পণ্যের ওপর কর বৃদ্ধির দাবি জানিয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে।
অভিযোগ আছে, ব্যবসার প্রসার এবং তামাক পণ্যের ওপর সরকার যাতে কর বাড়াতে না পারে সে জন্য তামাক কোম্পানিগুলো নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, তামাক কোম্পানিকে সহযোগিতা বা তাদের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ কিংবা তাদের প্রতারণা প্রতিরোধে নিষ্ক্রিয় থাকা প্রকারান্তরে মৃত্যুকেই উৎসাহিত করার শামিল।
কয়েক যুগ ধরে দেশে চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপণ্যের দাম যে হারে বেড়েছে মরণঘাতী তামাকজাত দ্রব্যের দাম সেই হারে বাড়েনি। এতে করে উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি।
তামাকের ওপর কর বাড়লে সরকার মোটা অংকের রাজস্ব হারাবে বলে বলা হলেও গবেষণায় এর উল্টো চিত্রই দেখা গেছে। গবেষণায় দেখা গেছে তামাকের ওপর শুল্ক হার বাড়িয়ে সরকারের আরও ৮শ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় বাড়ানো সম্ভব। এ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের ফলে একদিকে তরুণ সমাজ তামাক সেবনে যেমন নিরুৎসাহিত হবে তেমনি বর্তমান ব্যবহারকারীরাও তামাক ছাড়তে বাধ্য হবে। ফলে রাজস্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা হবে। এছাড়া টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন সহজ হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
এনবিআর কর্মকর্তাদের দেয়া তথ্যমতে, বর্তমানে তামাক খাত থেকে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাবদ বছরে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব পাওয়া যাচ্ছে। এর ৯৮ শতাংশই আসে সিগারেট খাত থেকে। বাকি ২ শতাংশের মধ্যে বিড়ি থেকে দেড় শতাংশ এবং জর্দা, গুলসহ ধোঁয়াবিহীন তামাক থেকে আসে দশমিক ৫ শতাংশ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডবিস্নউএইচও) মতে, বাংলাদেশে তামাক খাত থেকে সরকার যে রাজস্ব পায় তামাক ব্যবহারের কারণে অসুস্থ রোগীর চিকিৎসায় সরকারকে স্বাস্থ্য খাতে তার দ্বিগুণ অর্থ ব্যয় করতে হয়। তামাকজনিত মোট ক্ষতি হিসাব করলে তা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ৩ শতাংশ তামাকবিরোধী সংগঠন প্রগতির জন্য জ্ঞানের (প্রজ্ঞা) এক গবেষণায় দেখা গেছে, তামাক পণ্যের দাম বাড়লে প্রায় ৯০ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি বিড়ি সিগারেট সেবন ছাড়তে বাধ্য হবে। ৭০ লাখেরও বেশি তরুণ ধুমপান শুরু করা থেকে বিরত থাকবে। এছাড়া ধুমপানের কারণে সংঘটিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত প্রায় ৬০ লাখ লোক অকাল মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাবে।
গবেষণায় দেখা গেছে, করারোপের ফলে তামাকের প্রকৃত মূল্য ১০ শতাংশ বাড়লে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে তামাকের ব্যবহার ৫ শতাংশ কমে। কিন্তু বাংলাদেশে তামাক কর বিষয়ক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কার্যকর করারোপের অভাবে তামাকের প্রকৃত মূল্য বাড়েনি।
অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, সিগারেটের মূল্যস্তর প্রথায় কোম্পানিগুলো রাজস্ব ফাঁকি দেয়। বাজেটে তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করতে বিকল্প চাষে পুঁজি, প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য বরাদ্দ রাখা ও তা বাস্তবায়ন করা দরকার। তামাকে কর বাড়াতে হবে ব্যক্তির আয়ের চেয়ে বেশি হারে। প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত দেশ গড়ার কথা বলেছেন। ২০৩০ সালে তো এসডিজির শেষ বছর। পারলে ২০৩০ সালের আগেই কমিয়ে আনা উচিত।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অফ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অব.) আবদুল মালিক বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য পৃথিবীর মধ্যে বাংলাদেশেই সবচাইতে কম মূল্যে তামাকজাত দ্রব্য পাওয়া যায়। সাদাপাতা, জর্দা, গুল, বিড়ি ও সিগারেট সহজলভ্য হওয়ায় এ দেশের দরিদ্র মানুষের মধ্যে তামাক সেবন ও এর ফলে মানুষের রোগব্যাধির হার বেড়ে চলেছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে আমাদের অর্থনীতিতে। হৃদরোগসহ সব রোগের মূল কারণ তামাক। ৪০ বছরের নিচে যেসব রোগী হৃদরোগে আক্রান্ত তা ধূমপানের কারণে।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক সদস্য (করনীতি) মো. আমিনুর রহমান বলেন, রাজস্ব হারানো ও রাজস্ব ফাঁকির ভয়ে এনবিআর তামাকের কর কাঠামোয় পরিবর্তন করে না। ধোঁয়াবিহীন তামাক শনাক্ত ও কর আদায়ে এনবিআরের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা রয়েছে। এনবিআরের টোব্যাকো সেলকে কার্যকর করতে হবে। একই সঙ্গে নতুন ভ্যাট আইনের ৫৮ ধারা অনুযায়ী, স্পেসিফিক করারোপ করলে রাজস্ব ক্ষতি হবে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডবিস্নউএইচও), বাংলাদেশের ন্যাশনাল প্রফেশনাল অফিসার সৈয়দ মাহফুজুল হক বলেন, বাংলাদেশ সিগারেটের খুচরা মূল্যের ওপর শুল্ককর আরোপ করে। বিশ্বের মাত্র তিনটি দেশ এ পদ্ধতিতে শুল্ককর আরোপ করছে। বেশির ভাগ দেশই প্যাকেট প্রতি শুল্ককর নির্ধারণ করে দেয়, কোম্পানি যে দামেই তা বিক্রি করুক না কেন। ফলে ওই সব দেশে সিগারেটের দাম বেশি। এছাড়া বাংলাদেশে তামাক চাষ হওয়ায় সিগারেটের উৎপাদনে খরচ অনেক কম। আর দাম কম হওয়ায় এ দেশে ধূমপায়ীর সংখ্যা ও ধূমপানের পরিমাণ বেশি। বছরে আট হাজার কোটি পিস ফিল্টারযুক্ত সিগারেট এবং পাঁচ হাজার কোটি পিস ফিল্টার ছাড়া সিগারেট ও বিড়ি টানে বাংলাদেশের মানুষ।
তিনি বলেন, ধূমপায়ীর সংখ্যা ও ধূমপানের পরিমাণ কমাতে হলে বিড়ি-সিগারেটের দাম বাড়ানোর বিকল্প নেই। বিভিন্ন বৈশ্বিক গবেষণায় দেখা গেছে, সিগারেটের প্রকৃত মূল্য ১০ শতাংশ হারে বাড়লে ৮ শতাংশ হারে বিক্রি কমে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. রুমানা হক তার এক গবেষণায় বলেছেন, কার্যকরভাবে কর আরোপের মাধ্যমে তামাকের দাম বাড়ালে তামাক ব্যবহার সন্তোষজনক হারে কমবে। বাংলাদেশে তামাকের ওপর শুল্ক কাঠামো অত্যন্ত জটিল এবং তা আদায় করা হয় মূল্যের শতাংশ হারে। যা অতিরিক্ত জটিলতা তৈরি করে। কর ফাঁকির সম্ভাবনা বাড়ে। এ পদ্ধতির পরিবর্তে সকল তামাকজাত পণ্যের প্যাকেট বা কৌটা প্রতি সুনির্দিষ্ট করারোপের দাবি জানান তিনি।
এ প্রসঙ্গে প্রজ্ঞা'র নির্বাহী পরিচালক এবিএম জোবায়ের বলেন, যেকোন পণ্যের দাম বাড়লে ভোক্তাদের মধ্যে এর প্রভাব পড়ে। সারাবিশ্বে তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে এর ওপর কর বৃদ্ধি একটি অন্যতম উপায়। আন্তর্জাতিক তামাক নিয়ন্ত্রণ চুক্তি ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি), এর আর্টিকেল ৬-এ তামাকের মূল্য ও কর বাড়ানোর নির্দেশনা রয়েছে। কারণ, এতে সরকারের কোন অর্থ ব্যয় করতে হয় না। দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যখাতে সরকারের ব্যয় কমিয়ে আনতেও সহায়ক ভূমিকা রাখবে। তাই এ বিষয়ে সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া দরকার।

Source: The daily sangbad, 23 May, 2017

About Tobacco Industry Watch

House 6 (3rd Floor, East Side), Main Road 3, Block A, Section 11, Mirpur, Dhaka-1216
Tel: +88-02-9005553, Fax : +88-02-8060751,
URL : www.tobaccoindustrywatchbd.org, Skype ID: progga.bd

Email: progga.bd@gmail.com, info@tobaccoindustrywatchbd.org